১
প্রবাসে শিখা বহ্নিমান
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ক্যানাডা সংসদ
গরাদের অন্তরাল থেকে সত্যেন সেন মুক্ত বিহঙ্গের স্বপ্ন দেখেছিলেন। মুক্ত বিহঙ্গের স্বপ্ন হচ্ছে সীমানাবিহীন। উদীচী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সে স্বপ্ন প্রথম ডানা মেলে। রাজধানীর সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদীচী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মানুষের মুক্তির গান কন্ঠে ধারণ করে মুক্তবিহঙ্গ উদীচী এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত। স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু, মৃত্যু, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, উপহাস মাথায় নিয়েও উদীচীর জয়যাত্রা রয়েছে অব্যাহত। স¦দেশের চৌকাঠ পেরিয়ে উদীচী এখন বিদেশ বিভূঁইয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। টরন্টো, প্যারিস, সিডনি ও লন্ডনসহ আরও অনেক জায়গায়।
আশির দশকের শেষে টরন্টোর বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মূলতঃ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যানাডা, টরন্টোর তত্ত্বাবধয়ানে অনুাষ্ঠত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আসা উদীচীর নবাগত অভিবাসী কর্মীরা এই অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যামে তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। এসময় বাংলাদেশের জাতীয় দিবস ও রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী নিয়মিতভাবে পালন করা হতো। উদীচীর কর্মীদের প্রচেষ্টায় ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে ইটবিকোকে সরকারী অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বাংলা স্কুল যা বর্তমানে অন্যান্য এলাকায়ও সম্প্রসারিত হয়েছে। সংস্কৃতি যে সমাজ বদলের হাতিয়ার এবং দেশের বাইরে থেকেও এই সমাজ বদলের স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়া যায়, নতুন দেশের নতুন পরিবেশে এ ধারনাটি ছিল নিতান্তই নতুন। উদীচী সংস্কৃতিকে বিনোদন বা আনুষ্ঠানিকতার বাইরে নিয়ে আরও গণমুখী করার সংকল্প গ্রহণ করে। মানুষের মুক্তির গান স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে একই সূত্রে গাঁথা। ইতোমধ্যে টরন্টোয় বাঙালি অভিবাসীর সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। প্রায় এক দশকের অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর ১৯৯৮ সালে টরন্টো শহরে প্রথম উদীচীর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন নতুন কার্যক্রম নিয়ে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে হাজির হয় উদীচী ক্যানাডা। কখনো এককভাবে, কখনো যৌথ প্রয়াসে উদীচী তার কার্যক্রম চালিয়ে যায়। জাতীয় দিবস উদ্যাপনের
পাশাপাশি আবৃত্তি, নৃত্য, নাটক, গীতিনাট্য এরকম বহুমুখী অনুষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করে উদীচী। টরন্টোয় বাঙালি সমাজ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে উদীচীর অনুষ্ঠানসমূহ ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে। একইসঙ্গে সংগঠনের ভান্ডারে জমা হয় বহু সম্মাননা ও পদক। উদীচীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রায় প্রতি বছরই প্রকাশিত হয় বাংলা কবিতা, ছড়া ও প্রবন্ধ সমৃদ্ধ বিশেষ সংকলন ’সংহতি’।
উনিশ বছরের বহু সংগ্রাম ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে উদীচী ক্যানাডা এখন টরন্টো শহরে একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। কালের সিঁড়ি বেয়ে টরন্টোয় যেমন নতুন অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি গড়ে উঠেছে বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন। উদীচী সবসময়ই সমমনা সংগঠনগুলোর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। সংস্কৃতির সংগ্রামকে বেগবান করে তোলার ক্ষেত্রে উদীচী ক্যানাডার তৎপরতা সামনের দিনেও সমানভাবে অব্যাহত থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রায় দুই দশকের পথ চলায় উদীচী ক্যানাডা বহু মাইলফলক অতিক্রম করেছে এবং টরন্টোর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সৃষ্টি করেছে অনন্য ইতিহাস। কর্মবহুল সেই ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ সনের ক্রমানুসারে বিবৃত করা হল।
১৯৯৮ঃ
১লা নভেম্বর রোববার আজিজুল মালিকের বাসভবনে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কর্মী ও সহযোগিদের এক সভায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ক্যানাডা শাখা গঠন করা হয়। সভায় আজিজুল মালিক ও সুমন সাইয়েদকে যথাক্রমে আহবায়ক ও সদস্যসচিব করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেনঃ মামুনুর রশীদ, তপন সাইয়েদ, অপূর্ব কুমার দাস, ফৌজিয়া শাজনাজ শুভ্রা, মাসুদুর রহমান আহমেদ, সমরজিৎ রায় ও সাদেকা রহমান শাহী। ১৩ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যানাডা টরন্টোর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে উদীচীর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। অনুষ্ঠানে উদীচী পরিবেশন করে ’মানুষের গান শুনিয়ে যাই’ সঙ্গীতালেখ্য।
১৯৯৯ঃ
২
২৮শে আগষ্ট শনিবার উদীচীর এক সভায় আজিজুল মালিককে আহবায়ক করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ঠ প্রথম সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। সভায় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও সম্মেলন প্রস্ততির জন্য ৫টি উপ-পরিষদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যানাডা টরন্টোর স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে উদীচী পরিবশন করে ’ইাতহাস কথা কও’ সঙ্গীতানুষ্ঠান। ৭ই মার্চ উদীচী ক্যানাডা বাংলাদেশের যশোর জেলা সদরে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলায় নয়জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়।
২০০০ঃ
১২ নভেম্বর উদীচী ক্যানাডার প্রথম সম্মেলন ২৩৭ স্যাকভিল স্ট্রীটের বুলগেরিয়ান চার্চ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি সৈয়দ হাসান ইমাম ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সহ-আহবায়ক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার উপস্থিত ছিলেন। আজিজুল মালিককে সভাপতি ও সুমন সাইয়েদকে সাধারণ সস্পাদক করে উদীচী ক্যানাডা শাখার ৩৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
২০০১ঃ
উদীচী ক্যানাডা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে টরন্টোয় প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশের হাইকমিশনার, স্থানীয় ফেডারেল এমপি ম্যথিউ কেলওয়ে ও ইউনেস্কোর উপ-পরিচালকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি ভিন্ন মাত্রা পায় ও ভাষা দিবস পালনের পরম্পরা সৃষ্টি হয়। ঢাকায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় উদীচী ক্যানাডা প্রতিবাদ করে। ২৯শে এপ্রিল রোববার ২০৩ স্যাকভিল রিজেটপার্ক কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় রক্তে ভেজা বর্ষবরণ। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যানাডা, টরন্টোর উদ্যোগে রমনার বটমূলে হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ সভায় উদীচীর অংশগ্রহণ ও প্রতিবাদ জ্ঞাপন। উল্লেখ্য যে, টরন্টো শহরে উদীচীই প্রথম বাংলা
নববর্ষ উদ্যাপনের ঐতিহ্যবাহী ধারা সূচনা করে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে শিশুকিশোরদের অংশগ্রহণ নিশ্চিৎ করার জন্য নানামুখী প্রতিযোগিতা ও বিজয়ীদের সনদ প্রদানের ধারারও প্রচলন করে।
২০০২-২০০৪ঃ
উদীচী ক্যানাডা যথারীতি ভাষাদিবস, বর্ষবরণ, জাতীয় দিবস, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী ও প্রয়াণ দিবস পালন করে। অনুষ্ঠানগুলিতে পরিবেশন করা হয় গণসংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও শিশুকিশোরদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা।
২০০৫ঃ
উদীচী ক্যানাডা বিপুল উদ্যমে ’বর্ষবরণ উৎসব ১৪১২’ পালন করে। ২৩৭ স্যাকভিল এভিনিউস্থ বুলগেরিয়ান চার্চে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি ড. হায়াৎ মাহমুদ উপস্থিত থাকেন। উদীচীর পরিবেশনায় মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতি নৃত্যনাট্য ’তাসের দেশ’। নববর্ষ স্মরণিকা ১৪১২ হিসেবে ‘সংহতি’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
২০০৬ঃ
১৫ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ’বর্ষবরণ উৎসব ১৮১৩’। এবার বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি সৈয়দ হাসান ইমাম ও নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান। উদীচীর পরিবেশনায় শুভঙ্কর চক্রবর্তীর ‘মড়া’ নাটক মঞ্চন্থ হয়। বর্ষবরণ উপলক্ষে স্মরণিকা ‘সংহতি’ প্রকাশিত হয়।
২০০৭ঃ
বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন উদীচীর মূল অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়। ২১শে এপ্রিল শনিবার ৪৯ ফেলস্ট্যান্ড এভিনিউস্থ সেন্ট প্যাট্রিক হাইস্কুলে সারাদিনব্যাপী উদীচীর ‘বর্ষবরণ উৎসব ১৪১৪’ পালিত হয়। মাহমুদ সেলিম রচিত গীতি আলেখ্য ‘ইতিহাস কথা কও’ ও শিপ্রা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘হল্লা রাজার উৎপাত’ পরিবেশন করা হয়। নববর্ষ স্মরণিকা ‘সংহতি’ প্রকাশিত হয়।
৩
২০০৮ঃ
৩রা মে শনিবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ১৪১৫ সেন্ট প্যাট্রিক হ্ইা স্কুলে উদ্যাপিত হয়। মামুনুর রশীদের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় গীতিনাট্য ‘এ যুগের চারণ মোরা’ পরিবেশন করা হয়। কবিতা ও প্রবন্ধ সহযোগে যথারীতি প্রকাশিত হয় স্মরণিকা ‘সংহতি’। স্থানীয় পর্লামেন্ট সদস্য মারিয়া মিন্না, উদীচীর বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে শুভেচ্ছা সনদ প্রদান করেন। সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ফোরাম উদীচীর সভাপতিকে সনদ প্রদান করে সম্মানিত করে। হ্যামিল্টনে স্বাধীনতা দিবস ও নববর্ষ উদ্যাপনে উদীচীর অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন এর হ্যামিল্টন, উদীচী ক্যানাডা বরাবর প্রশাংসা সনদ প্রদান করে।
২০০৯ঃ
উদীচী ক্যানাডা ফেব্রæয়ারি মাসে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে ভাষা দিবস পালন করে। সংগঠনের কলা-কুশলী নিয়ে পরিবেশন করা হয় মূল অনুষ্ঠান ‘চেতনায় একুশের বর্ণমালা’। ২৫শে এপ্রিল শনিবার অনুিষ্ঠত হয় ‘বর্ষবরণ ১৪১৬’। উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করে গীতি আলেখ্য ‘অগ্নিস্নানে সূচী হোক ধরা’। এ উপলক্ষে প্রকাশিত হয় উদীচীর নিয়মিত প্রকাশনা ‘সংহতি’। অন্টারিও প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ডালটন ম্যাক-গুইনটি ও স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্য মারিয়া মিন্না উদীচীর বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে শুভেচ্ছা সনদ প্রদান করেন।
২০১০ঃ
১লা মে শনিবার বুলগেরিয়ান চার্চে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ ১৪১৭। উদীচী যুব কমিটির পরিবেশনায় গীতি আলেখ্য ‘ঋতু মঞ্জুরী’ ও উদীচীর নিজস্ব শিল্পীদের পরিবেশনায় ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ উপস্থাপন করা হয়। প্রবন্ধ ও কবিতা সহযোগে প্রকাশিত হয় ‘সংহতি’।
২০১১ঃ
১৩ই মার্চ ২৪৬ স্যাকভিল স্ট্রীটে অনুষ্ঠিত হয় উদীচী ক্যানাডার ৩য় সম্মেলন। সংগঠনের সভাপতি আজিজুল মালিক সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন করেন। সাধারণ সম্পাদক সুমন সাইয়েদ সংগঠনের বার্ষিক কার্যক্রমের রিপোর্টপেশ করেন। কাউন্সিল অধিবেশনের আলোচনায় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। আলোচকবৃন্দ নতুন প্রজন্মের সংগঠক মোহনা সাইয়েদ এর নেতৃত্বে পরিচালিত কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক নেটওয়ার্ক কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। ৩০শে এপ্রিল সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথলিক স্কুলে অনুষ্ঠিত হয় উদীচীর বর্ষবরণ উৎসব ১৪১৮। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠানটি নিবেদিত হয়। সারাদিনব্যাপী
এই অনুষ্ঠানে চলে বৈশাখী মেলা, আলোচনা, শিশুকিশোরদের প্রতিযোগিতা, উদীচী যুব কমিটির পরিবেশনায় গীতি আলেখ্য ‘রবি রশ্মি’। সবশেষে পরিবেশিত হয় নৃত্যনাট্য ‘চÐালিকা’। বিশেষ স্মরণিকা ‘সংহতি’তে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধ ও কবিতা। ৪ঠা জুন টরন্টো প্রবাসী বাঙালি সমাজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথলিক স্কুলে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আলোচনা, কবিগুরুর অনুনাটক, কাব্য জলসা, নৃত্য, সঙ্গীত ও ‘পোস্টমাস্টার’ নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। উদীচীর সভাপতি আজিজুল মালিক ও আরও কয়েকজন সদস্য এই অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। এ উপলক্ষে আজিজুল মালিকের সম্পাদনায় একটি সুন্দর স্মরণিকাও প্রকাশিত হয়।
২০১২ঃ
উদীচীর নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘বর্ষবরণ উৎসব ১৪১৯’ ৫ই মে সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথলিক স্কুলে অনুষ্ঠিত হয়। শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার-বিজয়ীদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেন বাংলাদেশ সরকারের ক্যানাডাস্থ ফার্স্ট সেক্রেটারী রাহাত বিন জামান। পরিবেশিত হয় উদীচী যুব কমিটির প্রয়াস গীতি-নৃত্যনাট্য ‘ভালবাসি তাই’ ও উদীচী শিল্পীদের করা গীতি আলেখ্য ‘আবহমান বাংলার লোকগীতি’। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কবিতা ও প্রবন্ধ সহকারে মুদ্রিত হয় ‘সংহতি’।
৪
২০১৩ঃ
উদীচী ক্যানাডা পালন করে অমর একুশে। প্রভাতফেরি ও গণসঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রাখার জন্য বেঙ্গলী কমিউনিটি অব গুয়েলফ উদীচী ক্যানাডার সভাপতি আজিজুল মালিককে সম্মাননা প্রদান করে। এপ্রিলে উদ্যাপিত হয় বর্ষবরণ উৎসব; আলোচনা, শিশুকিশোরদের প্রতিযোগিতা, সঙ্গীতানুষ্ঠান ও গীতিনৃত্যনাট্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দিবসের সমাপ্তি ঘটে। উদীচীর বর্ষবরণ উপলক্ষে স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্য ম্যাথিউ কেলওয়ে শুভেচ্ছা সনদ প্রদান করেন।
২০১৪ঃ
যথাযোগ্য মর্যাদায় উদীচী ক্যানাডা অমর একুশে পালন করে। ৩০শে মার্চ সংগঠনের ৪র্থ সম্মেলন ও স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন পিয়ার্ড রোডস্থ লিজিয়ন হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে কাউন্সিল অধিবেশন শেষে দীনা সাইয়েদকে সভাপতি ও সৌমেন সাহাকে সাধারণ সম্পাদক করে উদীচী ক্যানাডার ৪৩ সদস্যবিশিষ্টি নতুন জেলা কমিটি গঠন করা হয়। সন্ধ্যায় গণসঙ্গীতভিত্তিক গীতিআলেখ্য ‘নিঃশঙ্ক হাওয়ায় উড়–ক স্বাধীনতার গান’ এবং মান্নান হীরা রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তি নাটক ‘জননী বীরাঙ্গনা’ পরিবেশিত হয়।
২০১৫ঃ
২৯শে মার্চ রবিবার মিজান কমপ্লেক্স অডিটরিয়ামে উদীচী ক্যানাডা প্রথমবারের মত সত্যেন সেনের জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন করে। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পাঠ করেন স্বপন বিশ^াস ও দীনা সাইয়েদ। গণসঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। ২৩শে মে শনিবার ৩৮০ বার্চমাউন্ট রোডস্থ গ্র্যান্ড প্যালেস কনভেনশন সেন্টারে উদীচীর ‘লোক উৎসব ১৪২২’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক শহীদুজ্জামান সেলিম। শিশু-কিশোরেরা বিভিন্ন গ্রুপে আবৃত্তি, সঙ্গীত, নৃত্য ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় শেখর গোমেজের গ্রন্থনায় ‘বাজুক দ্রোহে রুদ্রবীণা’। সবশেষে পরিবেশিত হয় উদীচীর বহু কলা-কুশলীর সমন্বয়ে লোকজ সংস্কৃতিনির্ভর গীতিনৃত্যনাট্য ‘মহুয়া’। ‘মহুয়া’ পরিবেশনের দক্ষতায় শ্রোতা-দর্শকরা মুগ্ধ হন। লোক উৎসব ১৪২২ উপলক্ষে প্রকাশিত হয় উদীচী ক্যানাডার নিয়মিত স্মরণিকা ‘সংহতি’। ৩১শে অক্টোবর পালন করা হয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আলোচনা ও গণসঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। ৬ই নভেম্বর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সভায় গঠনতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রম, ভাবমূর্তি বিনষ্ট, শৃঙ্খলাভঙ্গ, কেন্দ্রীয় সংসদকে অমান্য করা এবং সংগঠনে উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ক্যানাডা সংসদের ৪ জন সদস্যকে সংগঠনের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান ও
উদীচীর প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
২০১৬ঃ
বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে উদীচীর ৫ম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসব ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা প্রেরণ করেন উদীচীর কোন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী। বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী দার্শনিক-সাহিত্যিক ডা. দেবাশীষ মৃধা। প্রথম দিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, আলোচনা, শিশুকিশোর প্রতিযোগিতা, সীমা বড়–য়ার পরিচালনায় নৃত্যগীতি আলেখ্য ‘রুখে দাও দানবের দাম্ভিক মিছিল’ ও তাপস দেবের পরিচালনায় লোক কাহিনীভিত্তিক গীতিনৃত্যনাট্য ‘সোনাই মাধব’ বুলগেরিয়ান চার্চের বড় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দিনে মিজান কমপ্লেক্স
অডিটরিয়ামে সম্পন্ন হয় সম্মেলনের উদ্বোধন, শোভাযাত্রা ও কাউন্সিল অধিবেশন। কামাল লোহানী, ড. করুণাময় গোস্বামী ও আজিজুল মালিকের লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত হয় ‘সংহতি’। ৫ম সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্য বিল মরন্যিউ এবং গ্লেন মুরে।
৫
সম্মেলন শেষে সৈয়দ আজফার ফেরদৌস ও সৌমেন সাহাকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে ৩৮ সদস্য বিশিষ্ট উদীচী ক্যানাডা শাখার কমিটি এবং ২০ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। নভেম্বরে উদীচী ক্যানাডার নবনির্বাচিত কার্যকর কমিটির সদস্যবৃন্দ উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরে এক সভায় মিলিত হন।
২০১৭ঃ
৫ই ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত ও বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর এবং উদীচী ক্যানাডার উপদেষ্টা মাহফুজুল বারীর প্রয়াণে স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। ২১শে ফেব্রæয়ারি প্রভাতফেরির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় অমর একুশে পালন করা হয়। ১লা এপ্রিলে উদ্যাপন করা হয় স্বাধীনতা দিবস ও সত্যেন সেনের জন্মবার্ষিকী। ১২ই মে শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ তোষণের প্রতিবাদে উদীচী ক্যানাডা টরন্টো শহরের সুধীজন ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মকবুল হোসেন এ সভায় উপস্থিত থাকেন। ২৮শে মে মৌলবাদের সাথে সরকারের আপস ও ভাষ্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে উদীচী ক্যানাডার ডাকে
নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২৯শে জুলাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী ও সঙ্গীতজ্ঞ সুধীন দাশের প্রয়াণে এক স্মরণসভা আয়োজিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী বেলায়েত হোসেন উপস্থিত থাকেন। ১৩ই আগষ্ট উদীচী ক্যানাডার উদ্যোগে ‘শুদ্ধ উচ্চারণ, আবৃত্তি ও উপস্থাপনা’ কর্মশালা আয়োজিত হয়। কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন কর্মশালা পরিচালনা করেন। ১৯শে আগস্ট বাংলাদেশে বন্যা দুর্গতদের সাহাযার্থে উদীচী ক্যানাডা ত্রাণ তৎপরতায় অংশগ্রহণ করে এবং কেন্দ্রীয় সংসদকে এক লক্ষ টাকা প্রদান করতে সক্ষম হয়।
সেপ্টেম্বর, ২০১৭
তথ্যসূত্রঃ আজিজুল মালিক, সদস্য, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ ও সাবেক সভাপতি, উদীচী ক্যানাডা ।
গ্রন্থনাঃ স্বপন বিশ্বাস, সহ-সভাপতি, উদীচী ক্যানাডা।