সত্যেন সেনঃ জীবন দর্শন ও কর্মজীবন প্রসঙ্গে

সত্যেনদা’ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। প্রগতিশীল একজন সংস্কৃতসেবীর বাহিরেও তাঁর অনেক পরিচয় আছে। তিনি লেখক মূলত উপন্যাসিক, রাজনীতিক মূলত কৃষক নেতা, সাংবাদিক মূলত চারণ সাংবাদিক, গীতিকার-সুরকার ও সখের গায়ক। বিজ্ঞান লেখক অনুবাদক, মার্ক্সবাদী বিপ্লবী সংগঠক ও মানবতাবাদী। তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ বলেছেন, শেষতক একজন লেখক হিসেবেই তিনি মানুষের মনে স্থায়িত্ব লাভ করেছেন। কেউ লিখেছেন, সংস্কৃতিসেবী হিসেবে তিনি বরণীয় হয়ে থাকবেন। এই দুটো মতের কোনটাই যে সত্য নয় বরং তিনি মূলত একজন কমিউনিষ্ট রাজনীতিক ছিলেন এই কথাটি স্বল্পপরিসরে এই রচনার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সত্যেনদা’র জীবন লেখনী ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সবকিছুর চালিকাশক্তি (Driving force) মার্কসবাদী লেনিনবাদী মতাদর্শ। একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ায় আমার উৎকন্ঠা সত্যেনদা’র রাজনৈতিক পরিচয়টি সামনে তুলে না ধরলে হারিয়ে যেতে পারে। তার সৃজনশীলতার পরশে বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সমৃদ্ধ হয়েছে। সত্যেনদা’ হচ্ছেন সেই পরশপাথর তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন, হোক না সে লোকালয়ে গ্রামে-গঞ্জে বা জেলখানায়, মুগ্ধ হয়েছেন প্রভাবিত হয়েছেন তাঁরা। নিরাহংকার এক বিপ্লবীর অপর নাম সত্যের সেন।

সত্যেনদার জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে গরাদের অন্তরালে। তিনি কলম ধরেছেন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর পার হওয়ার পর। লেখনীর ইতিহাসে এটি এক অনন্য ঘটনা। কেন এমনটি হয়েছে? তাঁর উপন্যাসের এর নায়কের জবানীতে উল্লেখ আছে ‘ইন্ট্রোভার্ট’ শব্দটি। প্রচলিত সামাজিক বিচারে তিনি ছিলেন অনেকটা লাজুক ও প্রচার বিমুখ কিন্তু তাই বলে অগ্নিপুরুষের যে অন্তর্দৃষ্টি হৃদয়ে ধারন করেছিলেন, তা কে খাঁটো করে দেখার উপায় নেই। কঠিনেরে ভালবেসে ছিলেন তিনি। প্রথম বই ভোরের বিহঙ্গী প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তখন তার বয়স বায়ান্ন। সম্ভবত তখনো তিনি জেলখানায়। তারপর আর থামেননি। জেল বা জেলের বাইরে যেখানেই থেকেছেন, লিখেছেন অবিরাম। একের পর এক প্রকাশিত হয় রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ। অভিশপ্ত নগরী, পাপের সন্তান, সেয়ানা, পদচিহ্ন, পুরুষমেধ, আলবেরুনী, সাত নম্বর ওয়ার্ড, বিদ্রোহী কৈবর্ত কুমার জীব অপরাজেয়, মা, উত্তরণ, একুশ ভাঙ্গে একুশ গড়ে, গ্রাম বাংলার পথে পথে, আমাদের পৃথিবী, মসল্লার যুদ্ধ, এটমের কথা, অভিযাত্রী, মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন, মনোরমা মাসীমা, প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ, বিপ্লবী রহমান মাষ্টার, সীমান্ত সূর্য আব্দুল গাফফার, জীব বিজ্ঞানের নানা কথা, পাতাবাহার ইত্যাদি। তাছাড়াও তিনি লিখেছেন অজ¯্র গান। জেলখানা থেকে পাঠিয়েছেন অগুণতি চিঠিপত্র।
সত্যেদা’র লেখা বইপত্রের মধ্যে অধিকাংশই ইতিহাস আশ্রয়ী রাজনৈতিক বা সামাজিক উপন্যাস বা নিজের জীবন থেকে নেয়া গল্প। পাকিস্তান আমলে বাঙ্গালী লেখকদের অনেকে ইতিহাস আশ্রয়ী গল্প, উপন্যাস ও নাটক লিখেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই ধারাটি আর লক্ষ্য করা যায় না। গ্রন্থ তালিকায় আলবেরুনীসহ তিনটি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে। সবচে’ কম আলোচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ ও একমাত্র অনুদিত গ্রন্থ হচ্ছে ‘ইতিহাস ও বিজ্ঞান (২ খন্ড)। মূল বই Science of History লিখেছেন ব্রিটেনের কমিউনিস্ট ‘ক্রিস্টালোগ্রাফার’ নামে খ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল বা জেডি বার্নাল। সত্যেনদা’র প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানমনস্কতা বোঝাবার জন্য বার্নাল সম্পর্কে দু’ চার কথা বলা দরকার। বার্ণাল ক্রিস্টালোগ্রাফীর অনেকগুলো মৌলিক ও যুগান্তকারী কৌশল আবিস্কার করেছেন।

তাঁর সুপারভাইজর উইলিয়াম ব্র্যাগ নোবেল পুরুস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী। আর বার্নালের নিজের তত্ত¡াবধানে বেশ ক’জন (চারের অধিক) পিএইচডি’র ছাত্র ও গবেষক নোবেল পুরস্কার পেয়ে সম্মানিত হয়েছেন। বার্নাল কেন নোবেল পাননি এটি একটি রহস্য। তাঁর ছাত্রী ডরথি হজকিন লিখেছেন, তাকে একা নোবেল দেয়া ঠিক হয়নি, তাঁর সঙ্গে গুরু বার্নালকে যুক্ত করা সব অর্থেই সমীচীন ছিল। যদিও নোবেল সবকিছুর মাপকাঠি নয়। বিজ্ঞানীদের তরফ থেকে তবুও প্রশ্ন উঠেছিল, গবেষণার এতগুলো মৌলিক ও যুগান্তকারী আবিষ্কার থাকা সত্বেও তাকে কেন এই সম্মান দেয়া হয়নি। তাত্তি¡ক ও ব্যবহারিকভাবে মাকর্সবাদী রাজনীতিতে বার্ণাল এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া অনেকের দৃষ্টিকোন থেকে বিপজ্জনক মনে হয়েছিল। কথিত আছে যে, ব্রিটেনের এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী বোন্বের এক শ্রমিক সভায় বক্তৃতা করতে এসেছিলেন। ক্রিষ্টালোগ্রাফীর কৌশল ব্যবহার করে যিনি পানির অণুর গঠনকে ‘বুমেরাং’ এর প্রতিফলন দেখেছিলেন। রাজনীতি হয়তো তাঁর ক্যারিয়ারে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। বিজ্ঞান গবেষনার বাইরে বার্ণাল লিখেছেন বহল আলোচিত অসাধারন গ্রন্থ The Social Functions of Science Ges Science in History (৪ খন্ড) বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর উক্তি “ Science will not fail for lack of human capacity; when it fails will be for lack of social organizations to make use of that capacity.” ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, এন্টি-কলনিয়ালিজম ও এন্টি-ইমপিরিয়ালিষ্ট দুনিয়া সৃষ্টিতে তিনি নিয়মিতভাবে চৌ এন লাই, মাওসেতুং, ক্রুশ্চেভ, নক্রুমা ও নেহেরুসহ বহু রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পিকাসো, নাজিম হিকমত, পল রবসন ও পাবলো নেরুদা তাঁর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। সত্যেনদা’র প্রায় সমসাময়িক এই বিপ্লবী বিজ্ঞানীর বই Science in History অনুবাদ করে তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন বিষয়ের সংযোজন করেছেন।
১৯৫৯ সালের পর বলতে গেলে প্রায় এক যুগের ব্যবধানে সত্যেনদা’ এতগুলো গ্রন্থ কি করে লিখলেন? তাও থেকে থেকে কারাবাস লেগেই ছিল। লক্ষ্যের প্রতি অবিচল আস্থা, আত্মত্যাগ, নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ও ক্লান্তিহীন সাধনা ব্যতীত এই কাজ প্রায় অসম্ভব। চোখের অসুবিধা নিয়েও তিনি নিরন্তর লিখেছেন। জেলখানায় চেয়ার টেবিল ছিল না, সিমেন্টের মেঝেতে কনুইয়ে ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে লিখতেন। শেষ বয়সে এমনকি অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তাঁর লেখা থেমে ছিল না; নিজে বলছেন অন্য একজন তাঁর পক্ষে লিখতেন।
আগেই বলেছি, সত্যেনদা’র বইয়ের উপাদান ইতিহাস ও জীবন থেকে নেয়া। খ্রীষ্টপূর্ব ২৭০০ সাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা তাঁর গল্প ও উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। সমাজে যারা সবার পিছে সবার নিচে তাদের ইতিহাস-বিদ্রোহ-জয়-পরাজয় তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়, অনবদ্য উপমা ও প্রাণস্পর্শী মমতায়। বইটির নাম মনে নেই; নায়ক …….. সহকারে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। কাল পিপীলিকার মত সারি সারি অক্ষর গুলোয় কি আকর্ষণ! পিপিলিকার মত কাল কাল অক্ষর কি সুন্দর উপমা। চার দশক গত হয়েছে কিন্তু এই উপমাটি আমি মনে রেখেছি। সত্যেনদা’ টিভি সিরিয়াল বা বইমেলাকে উপলক্ষ করে লেখেননি- লিখেছেন মানুষের জন্য সমাজ প্রগতির জন্য ও মেহনতী মানুষের বিজয়কে অনিবার্য করে তোলার জন্য। লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সাহিত্য আদমজী পুরুস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক পান।
লেখালোখির জগতে যাঁর এতটা অবদান, তাঁর প্রধান পরিচয় সাহিত্য বা সংস্কৃতিসেবী হিসেবে নয়। তিনি রাজনীতিক, কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত কৃষক নেতা, উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নিয়েও সত্যেনদা’ সকল বিত্ত ও ভোগ পরিহার করে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সুশীল লেখক ও সংস্কৃতিসেবী হলে তাকে বার বার কারাবাসে যেতে হত না। সেই যে যুবক বয়স থেকে গ্রেফতার নির্যাতন ও কারাবরণ শুরু হয়, মৃত্যুর এক দশক পূর্ব পর্যন্ত তা চলতেই থাকে। জেলে বসেই তিনি এম.এ পাশ করেন ও অধিকাংশ বইপত্র লিখেন। বই লিখে বা সাংবাদিকতা করে যে আয় হত তাও গরীব সহকর্মী ও অভাবী মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। অকৃতদার এই রাজনৈতিক মনীষীর অপ্রাপ্তি নিয়ে কোন আক্ষেপ ছিল না। তাঁর জীবন দর্শনের সারসংক্ষেপ ফুটে উঠেছে তারই লেখা গানের কলিতে:
“মানুষের কাছে পেয়েছি যে বানী, তাই দিয়ে রচি’ গান
মানুষের কাছে ঢেলে দিয়ে যাবো, মানুষের দেয়া প্রাণ।”

সত্যেনদা শুধু দিয়েই গেছেন, নিয়ে যাননি কিছু। তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি বেঁচে আছেন মানুষের স্মৃতিতে। তাঁর জন্য রইল আমাদের প্রাণঢালা ভালবাসা ও লাল সালাম। তার মুত্যু নেই। তিনি বেঁচে আছেন মানুষের স্মৃতিতে।


একজন রণেশ দাশগুপ্ত হয়ে উঠা

উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে যে তথ্যটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে, তা হলো, রণেশ দাশগুপ্ত হলেন উদীচীর গঠনতন্ত্রের রচয়িতা ।
সচররাচর জীবনী রচনায় সাধাররত: জন্ম, শৈশব, যৌবন, স্কুল-কলেজে পড়ালেখা, কর্মজীবন, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করা হয় । আমাদের এই রচনাটিকে একটু ভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে । একজন ব্যক্তি কি করে বড় হয়ে ওঠেন, প্রজ্ঞাবান ও নিষ্ঠাবান হয়, তার কোন সোজা-সাপটা ফর্মুলা নাই । কিন্তু কিছু প্রবণতা আছে, যা দিয়ে একজনের বড় হয়ে উঠা ও অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় । রণেশ দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে শৈশবে তাঁর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর, বড় পরিবার, সংগঠন, একাধিক ভাষায় প্রবেশাধিকার, সরল জীবন-যাপন তাঁকে আলাদাভাবে গড়ে তুলতে প্রণোদনা জুগিয়েছে । তাই এ লেখাটি জীবনী নয়, কিছু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জীবন বিচারের প্রয়াস ।

রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২ সালে, মৃত্যু ১৯৯৭ সালে । জন্ম আসামের ডিব্রুগড়ে হলেও শৈশবে লেখাপড়া শুরু হয় রাঁচিতে, তারপরে যান পুরুলিয়ায়, আবার ফিরেন রাঁচিতে । স্কুল পেরিয়ে কলেজেও একই অবস্থা; প্রথমে বাঁকুড়া ক্রিস্টান কলেজ, পড়ে কলিকাতা সিটি কলেজ ও সবশেষে বরিশাল বি এম কলেজ । এই যে স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন, এটা শুধু জায়গা বদল নয়, এর অভিজ্ঞতা মানুষকে বিশাল করে তোলে । নতুন জায়গা, নতুন স্কুল, নতুন শিক্ষক, নতুন বন্ধু, নতুন সমস্যা ও নতুন সম্ভাবনা এসবকিছুই অভিজ্ঞতার পেয়ালা ভরে দেয় । নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে একজন কৌতুহলী কিশোর পূর্ণবয়স্ক লোকের মত চিন্তা করতে সক্ষম হতে পারে । দেখে, ঠেকে, শিখে একজন ব্যক্তি উদ্যমী, সহনশীল, দূরদর্শী ও অতুলনীয় হয়ে উঠে । রণেশ দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল বলে অনুমান করি ।
বড় পরিবারে বেড়ে উঠেছেন রণেশ দাশগুপ্ত । চার ভাই সাত বোন আর বাবা মা । দু’বোন অকালে মারা যান । রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন: এক জরিপে দেখা গেছে যে, সাধারণতঃ বড় পরিবারে আর দীর্ঘকায়া লোকেদের মধ্যে মহাপুরুষের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায় না । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এর ব্যতিক্রম । বড় পরিবার বিবেচনায় রণেশ দাশগুপ্তও ব্যতিক্রম । তিনি ছিপছিপে দীর্ঘকায়া ছিলেন । তবে রাজনীতির প্রেরণা তিনি পান পারিবারিক পরিমন্ডলে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে । বাবার কাছ থেকে পান ক্রীড়ামোদী হওয়ার প্রেরণা আর মায়ের কাছ থেকে পান সাহিত্য পথের নেশা । বড় পরিবারে টানাপোড়েনের শেকল যেমন আটকে রাখতে পারে, আবার তা ভাঙ্গার প্রনোদনাও জোগাতে পারে ।

রণেশ দাশগুপ্ত স্কুলজীবন থেকেই সংগঠনে জড়িয়ে পরেন । ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে উত্তরণের প্রধান উপায় হলো সংগঠন । ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মন্ত্রে যারা বিশ্বাসী, তাদের কাছে সংগঠনের কোনো বিকল্প নাই । তা সে রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠন, যাই হোক না কেন । সংগঠনের শক্তি ব্যক্তির কাজের সমষ্টির চেয়ে বেশি । এই প্রক্রিয়াটিকে ংুহবৎমু বলা হয় । যেমন, ংুহবৎমু অবস্থায় ২ + ২ = ৪ হয় না, ৫, ৬ কিংবা ৭ হতে পারে । এটি একটি পড়হপবঢ়ঃ । স্কুলে থাকা অবস্থায় অনুশীলন সংঘে যোগদানের মাধ্যমে রণেশ দাশগুপ্ত-এর যাত্রা শুরু । কলেজে এসে তৈরী করেন বিপ্লবী গ্রূপ – ‘জাগরণী গোষ্ঠী’ । কারাগারে গিয়ে চালু করেন সাহিত্যের ‘অনুশীলন চক্র’ । যুক্ত হন কমুনিস্ট পার্টির সঙ্গে । ১৯৫৮ সালে পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁতিবাজার এলাকা থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন । বলতে পারেন আজকের মত সেসময়ে ভোট ডাকাতির প্রক্রিয়া শুরু হয়নি । তিনি ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র অন্যতম সংগঠক ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । আবার তিনি শিশু কিশোর আন্দোলন ‘খেলাঘর’-এরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন । আমরা যে ‘উদীচী’র পতাকাতলে সমবেত হয়েছি, সত্যেন সেনের সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তও তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা । শুরুতে উল্লেখ করেছি, তিনি উদীচীর গঠনতন্ত্রের প্রণেতা । সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে অবিরাম তিনি জীবনধর্মী কাজ করে গেছেন । বিশাল পৃথিবীর বাইরে বার বার যেখানে তিনি গিয়েছেন, তা হলো জেলখানা । জেলখানায় বসেও সংগঠন ও জ্ঞানচর্চা বাদ পরেনি রণেশ দাশগুপ্তের । জেলখানায় বসে তিনি জেলের সহপাঠী রাজবন্দী মুনীর চৌধুরীকে ‘কবর’ নাটক লিখতে ও মঞ্চস্থ করতে উদ্বুদ্ধ করেন । রাজবন্দীদের জড়ো করে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাসও নিয়েছেন তিনি । বিভিন্ন সময়ে কারাগারে তাঁর সাথী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, তফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া, সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, সরদার ফজলুল করিম, কামাল লোহানী প্রমুখ । বক্তৃতা, লেখনি ও বেতার কথিকার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন । এই হলো রণেশ দাশগুপ্তের সংগঠন বা সংগঠনের রণেশ দাশগুপ্ত ।
জানা গেছে যে, রণেশ দাশগুপ্ত বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন । একাধিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার মানে হলো সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বহুমুখী দরজায় করাঘাত করার যোগ্যতা অর্জন করা । এক্ষেত্রেও ংুহবৎমু কাজ করে । নিজের সৃজনশীল লেখালেখির মাধ্যমে রণেশ দাশগুপ্ত সেই পরিচয় দিয়েছেন । তিনি স্বজাতির সৃষ্টিসম্ভার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে গিয়েছিলেন । তাঁর মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন ধর্মী সাংবাদিতা, শিল্পসাহিত্যের বিশ্লেষণ গুণেমানে অসাধারণ । সময়ের সীমাবদ্ধতার জন্য রণেশ দাশগুপ্তের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বই-পত্তর নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই । কিন্তু স্বল্প পরিসরে হলেও তাঁর বইপত্রের একটি খসড়া তালিকা এখানে পড়ে শোনাতে চাই । রণেশ দাশগুপ্ত মূলতঃ লিখেছেন সৃজনশীল প্রবন্ধ । তাঁর অনুবাদ গ্রন্থও অনেক । প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’, ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’, ‘ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম’, ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালা’, ‘আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ’, অনূদিত গ্রন্থ ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা’, মাও সে তুং-এর ‘শতফুল ফুটতে দাও’, হেনরি এলেগের ‘দ্যা কোয়েশ্চেন’, সম্পাদিত/সংকলিত গ্রন্থ ‘জীবনানন্দ দাসের কাব্যসম্ভার’ ‘গোর্কি-মায়াকভস্কি-নেরুদার কবিতা’, স্বাধীনতা-সাম্য-বিপ্লবের কবিতা’, অন্যান্য গ্রন্থ ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’, ‘রহমানের মা ও অন্যান্য গল্প’, ‘সাজ্জাদ জহির প্রমুখ’, ‘মুক্তিধারা’, ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’, ‘কখনো চম্পা কখনো অতশী’ ইত্যাদি । এছাড়াও কিশোরদের জন্য লিখেন নাটক ‘জানালা’ এবং রচনা করেন ‘কার্ল মার্কসের জীবনী’।
সরল জীবনযাপনের পরিমাপে রণেশ দাশগুপ্তকে বলা হয় ঋষিতুল্য মানুষ । মহাত্মা গান্ধী বলতেন, ‘আমার জীবন আমার দর্শন’ । রণেশ দাশগুপ্তের জীবনযাপন যেন সেই কথার প্রতিধ্বনি । জ্ঞানের উচ্চ শিখরে পৌঁছেও আচার ব্যবহারে তিনি ছিলেন অমায়িক । মানব প্রেমের যে পরাকাষ্ঠা তিনি দেখিয়েছেন, তার তুলনা নেই । অল্পেতে তুষ্ট থেকেছেন তিনি । তাঁর উদারতার ও সরলতার দুটি গল্প বলেই শেষ করব এই রচনা ।
রণেশ-দা তখন কাজ করতেন সংবাদ পত্রিকায়; রবিবাসরীয় সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্বপাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তিনি । সেসময়ে সাহিত্য পাতার লেখকদের সম্মানী দেয়া হত না । রণেশ-দা, আহমদ ছফার লেখা কয়েক কিস্তিতে ছাপেন ও তাকে সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থা করেন । বাস্তবে, রণেশ-দা গোপনে তাঁর নিজের বেতনের পুরোটাই আহমদ ছফাকে দিয়ে দেন । এ তথ্যটি আহমদ ছফা নিজেই প্রকাশ করেছেন ।
বিপ্লবের পরে প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত হয়ে কমরেড লেনিন কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন । তাঁর স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রুটির সঙ্গে কেকও দিতেন । কেক ফিরিয়ে দিয়েছেন লেনিন, বলেছেন, ‘যতক্ষণ সবাই রুটি পাছে না ততক্ষণ আমি কেক খেতে পারি না’ । কয়েক বছর আগে টরন্টোতে উদীচীর একটি সভায় ড. করুণাময় গোস্বামী বলেন, রণেশ-দাকে তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছেন । খাবার টেবিলে গিয়ে রণেশ-দা আর খাবার মুখে তুলছেন না । গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তা দুজনেই অবাক । রণেশ-দা বললেন, আমি চিকন চালের ভাত খাই না । তিনি অনড় । তাঁর জন্য পাশের বাড়ি থেকে মোটা চাল এনে ভাত পাক করার পর শুধু ডাল দিয়ে অল্প খেলেন । গরীব-দু:খী মানুষের সাথে একাত্ম হতে সুস্বাদু খাবার পরিহার করেছিলেন তিনি । ড. গোস্বামী শেষ করলেন এই বলে, “আহা, এই মানুষগুলি আমাদের মধ্যে ছিল !”
একজন রণেশ দাশগুপ্তকে বোঝবার জন্য বাংলা সাহিত্য জগতের আরেক মনীষী শওকত ওসমানের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি । তিনি লিখেছেন,
‘মানুষ হিসেবে তোমার সীমানায় পৌঁছাব এমন স্পর্ধা কখনো করিনি পোষন,
গৌরী শৃঙ্গের পানে বিস্ময়াহত চেয়ে থাকি ।
তোমার স্মৃতি চিরকাল বহন করে সঞ্জীবনী গুণ,
আহা হতে পারতাম যদি তোমার মত মালাউন’ ।

কলমে – স্বপন বিশ্বাস